১.
সেদিন ছিল রাত। আমি ঘুরছি। এরকম হয় আমার। আমি একটু অন্যধারার মানুষ। আমি বুঝি। আমার সাথে কারো খুউব ভিতরে মিল খায় না। আমি সেটা কাউকে বুঝতে দেই না। নিজেকে আড়াল করার কৌশল আমি ভালো রপ্ত করেছি। বাঁচার জন্য আমাকে এসব শিখতে হয়েছে। নানা অঘটন আর যন্ত্রণাময় পৃথিবীতে নিজেকে আড়াল করা একটু কঠিন বৈকি! কেউ কেউ মনে করে আমি ’তার’ লোক; বস্তুত তা না। আমি সেকথা তাকে বুঝতে দেই না। যাকে আমি কাছের মনে করি, সে থাকে গোপনে। আমি বলিনা। ইচ্ছে করেনা বলতে। ভালোবাসার একটা রূপগন্ধ আছে। টের পাওয়া যায়। আমার ভিতরে দুটো সত্তা বাস করে। একটা একান্ত নিজস্ব আর একটা সাধারণ। দুটোর মধ্যে অর্হনিশ একটা লড়াই চলে এবং প্রথমটার কাছে দ্বিতীয়টা যথারীতি হেরে যায়।
আমি সেই রাতে ঘুরছি। একাকী। একাকী পথ চলার আনন্দ আমি উপভোগ করি। রাত তখন ন’টা। শীতের রাতকে মধ্যরাত মনে হয়। বাইরে একটা অদ্ভুত মায়াবী পরিবেশ। কোলাহলহীন রাস্তা দিয়ে আমি যাচ্ছি। নিরুদ্বিগ্ন আমি। আমার কোনো গন্তব্য নেই। গেলেই হয়। পথ হারানোতেও ভয় নেই। এক সময় ঠিকই আমি ফিরবো। ফিরতে হয়। বাইরে কী সুন্দর শুভ্রতা। পেলব মায়াবী রাত। আকাশ থেকে ঝরে পড়ছে থোকা থোকা শিউলি ফুল! অঝোরে। পড়তে পড়তে স্তুপ হয়ে যাচ্ছে। আমার গাড়ির উইন্ডশিল্ড শুভ্রতায় আচ্ছাদিত হচ্ছে। আমি গাড়িটা পার্ক করে বাইরে বের হলাম। আমার কালো কোট ধীরে ধীরে ঢেকে যাচ্ছে শুভ্রতায়। ধব ধবে সাদা লাগছে নিজেকে। নিজেকে মনে হচ্ছে একটা কফিনের মধ্যে আচ্ছাদিত হয়ে যাচ্ছি। আমার মা’কে যখন সাদা কাফনের কাপড়ে আচ্ছাদিত করা হয়েছিল সেই দৃশ্যও অনেকটা এরকমই হওয়ার কথা! আমি দিখিনি। আমি দু’হাত দিয়ে শিউলি ফুল ধরছি। ফুলেরা ভেঙ্গে যাচ্ছে, গলে যাচ্ছে। আহা কী মোলায়েম! কটন ক্যান্ডি বা পেজা তুলোর মতো উড়ে উড়ে যাচ্ছে, ঝরে পড়ছে বরফ। প্রকৃতি ঢেকে গেছে কবরের নিরবতায়। যে কবরে আমার মা ঘুমিয়ে আছেন। একাকী! জানিনা মা কেমন আছেন! জানা যায় না।
বিকেল যখন ঘনিয়ে আসে তখন মাঠের ওধারে জরামরি গাছপালার ফাঁকে যে কী তুলকলাম একটা কাণ্ড ঘটে যায় রোজ তা কেউ তাকিয়েই দেখে না ভাল করে। আকাশ থেকে আলোর চাকাটা তখন নামতে থাকে আর সেই সময়ে কোথাও কিছু না হঠাৎ একটা ভুতুরে মেঘ এসে তিন-চার খন্ড হয়ে ভাসতে থাকে। আর গাছপালার কালচে রঙের ছায়া থেকে অশরীরীর মতো ভেসে উঠতে থাকে ঘোর ঘোর কুয়াশার মতো, ধোঁয়ার মতো, প্রেতের মতো সব জিনিস। পশ্চিমের আকাশে তখন লাল সাদা কালো মেঘের তুলির টান। দিগন্ত দ্রুত তার আলোর গালিচা গুটিয়ে নিতে থাকে। প্রথমে দীর্ঘ ছায়া দীর্ঘতর হতে থাকে, আর অন্ধকার বুনে চলে কালো এক মাকড়সা।
২.
প্রতিদিন এইভাবে দিন যায়, দিন আসে। জীবন থেকে এক একটা স্বর্ণালী মুহূর্ত খসে পড়ে। যখন আমি এইভাবে একা হয়ে যাই, ভীষণভাবে একাকী, ভাবি জীবন কত অকিঞ্চিতকর! মানুষ যে কেনো তা বোঝেনা! মানুষের ধারনা কত কী আছে তার চারিদিকে! অহংকার, বন্ধুত্ব, প্রেম, আত্মীয়, নিরাপত্তা। আসলে কিছু কী আছে! কিছু কী থাকে জীবনে! আমি ইদানীং একটা নির্লিপ্ততার ঘেরাটোপে বন্দী হয়ে গেছি। সময় আমার কেড়ে নিয়ে গেছে নিঃসীম নিঃসঙ্গতার পারাপারে। কোলাহল আমাকে আকৃষ্ট করে না। আমি কখনই কোলাহলপ্রিয় ছিলাম না। মানুষের দঙ্গলে আমি হাঁপিয়ে উঠি। অস্বস্তিবোধ করি।
মানুষের ভাষা আমার বোধগম্য হয় না। আমার ভাষাও তারা বোঝে না। আমি নির্বাক হয়ে মানুষের কান্ডকারখানা দেখি। নিজেকে মাঝে মাঝে ভোম্বল ভোম্বল লাগে। সবকিছু দেখে শুনে হয় গৌতমবুদ্ধুর মতো গৃহত্যাগী হয়ে যাই। মানুষের কোলাহলের চেয়ে নির্জন গুহায় গিয়ে থাকা অনেক ভাল। স্তব্ধতার কানে কানে আমি শুনতে পাই আমার নিজের অন্তরের আর্তনাদ। আমি আসলে নিজেকে বুঝিনা। কাউকে বোঝাতেও পারি না। কেউ আমাকে সঠিক বোঝে বলেও মনে হয় না। যাদের বোঝার কথা ছিল তারা বোঝেনি। আমাকে নিয়ে কখনও কথা হলে আমি অস্বস্তিতে পড়ি। প্রশংসা বা সমালোচনা কোনোটারই সঠিক উত্তর করতে পারি না। আমি কারো কাছে কিছু প্রত্যাশা করি না। চেনা মানুষরা সাধারণতঃ সমালোচনা করতে পছন্দ করে। তাদের ধারনা, ’আরে এ তো আমাদের জসিম! আমাদের সাথে পড়েছে! লেখালেখি নাকি করে! কী লেখে কে জানে! ওর আবার কিসের সুখদু:খ!’ এইভাবেই চেনা মানুষেরা মূল্যায়ন করে। কিন্তু সেজন্য আমার কোনো অনুতাপ হয় না। আমি এই মূল্যায়ন নিয়ে চিন্তিত নই। বরং আমার প্রতি কম মনোযোগ আমার জন্য স্বস্তিদায়ক।
আমি জানি আমার মধ্যে ভীষণ রকম অসম্পূর্ণতা রয়েছে। আমি নিজেকে কখনই গুছিয়ে প্রকাশ করতে পারিনি। কিভাবে নিজেকে তুলে ধরতে হয় সেই কৌশলটা আমার জানা নেই। আমি গুছিয়ে ভালোবাসতেও পারিনি। আমার মধ্যে যে এক ধরনের চাঞ্চল্য আছে তাই আমাকে কখনও স্থির হতে দেয়নি। আমি খুবই একজন ইমপারফেক্ট মানুষ। কোনো কিছুই আমি পরিকল্পনা করে করতে পারিনি। এই যে আমি একজন এলেবেলে টাইপ লেখক, সেই লেখাটাও আমি ঠিকঠাক মতো গুছিয়ে লিখলাম না। আসলে নিজেকে গুছিয়ে একজায়গায় জড়ো করা যায় না। আমার ভিতরে সুরের যে একটা মায়াজাল ছিল কোথায় যেনো একটা তার ছিঁড়ে গেছে। সেটা কিছুতেই আর জোড়া লাগতে চাইছে না।
৩.
যখন নির্জন ফাঁকা রাস্তা দিয়ে হাঁটি তখন নিবিড় ঝিম ঝিম, অনুত্তেজক নৈ:শব্দ ঘিরে ধরে আমাকে। ঘিরে ধরে ভেজা মাটির গন্ধ। ঘিরে ধরে গাছপালা। মনে হয় এরাই আমার বন্ধু। মানুষেরা আমার কেউ না। প্রতিটি বৃক্ষ, কীটপতঙ্গ, তৃণভূমি, নদী, পশুপাখি সব আমার বন্ধু। মনে মনে ভাবি একদিন আমি শহরের বাস ঘুচিয়ে চলে যাব গাঁয়ে। গরুর গাড়ি, ডোবার গর্ত, পানিতে ভরভরন্ত, খানাখন্দ ভেঙে, কাদা ঘেঁটে হাঁটব, মাটি মাখব, ভাব করব পৃথিবীর সঙ্গে। আল পথ দিয়ে মাইলের পর মাইল হেঁটে চলে যাবো। ক্ষেতগুলো ডুবে থাকবে পানিতে, চিনে জোক রক্ত চুষে নেবে, ক্রমে নিবিড় থেকে নিবিড়তর গাঁয়ের মধ্যে চলে যেতে যেতে দু’খানা চোখ রূপমুগ্ধ সম্মোহিত হয়ে মা’কে খুঁজে বেড়াবে।
যতটা দরকার ছিল ঠিক ততটা মায়ের পাশে থাকতে পারিনি। খুব কৈশোরে বরিশাল ছাড়া বাইরের জগত কিছুই জানতাম না। কিভাবে যে একদিন আমি বেড়িয়ে পড়লাম পৃথিবীর বুকে! ওখানকার জল-হাওয়া-মাটি আমাকে কিছু বলতে চাইত। আমার বন্ধুর মতো ছিল সব। আমি গাছের সঙ্গে, পোকামাকড়ের সঙ্গে, কুকুর-বেড়াল-গরুর সঙ্গে. পাখির সঙ্গে কথা বলতাম। সবসময় যেন আনন্দ একটা নদীর মতো কুলকুল করে বয়ে যেত বুকের ভিতর দিয়ে। তখন খুব মনে হত, আমি কখনও একা নই। আমার সঙ্গে গাছপালা, পশুপাখি সবাই আছে। আর আছে আমার মা। এখন এতটা বয়সেও এক যুক্তিহীন বাচ্চা ছেলে আমাকে হাত ধরে কেবলই টান। খুব টানে।
ওখানকার মাটির ভিতর দিয়ে একটা প্রাণের স্পন্দন আমার শরীরে উঠে আসত। বর্ষাকালে ভীষণ বাজ পড়ত, ঝড়-বাদল তো ছিলই। মাঠ ঘাট পানিতে টইটুম্বুর হয়ে যেতো। কিন্তু ভয় করত না। খোলা মাঠের মধ্যে, ঝড়-বাদলে, বজ্রপাতের মধ্যে খুব তুচ্ছ লাগত নিজেকে। মনে হত, এই তো এইটুকু আমি। আমি মরে গেলেও তো কিছু নয়। ওই বিরাট আকাশ, ভীষণ বৃষ্টি, মস্ত নীল আগুনের ঝলক এত ঘটনার মধ্যে মৃত্যু এমন কীই বা!
টরন্টো, ২০ ডিসেম্বর ২০১০
jasim.mallik@gmail.com
No comments:
Post a Comment